আল কুরআনের বিভিন্ন হারফ (বহুবচনে আহরুফ), কিরাআত ইত্যাদি নিয়ে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কুরআন মুফাসসির ইমাম ইবন কাসির(র.) এর আলোচনা। তাফসির ইবন কাসির ১ম খণ্ড থেকে।
মুহাদ্দিস আবু উবায়দ বলেন- বিপুল সংখ্যক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, কুরআন মাজিদ ‘৭টি হারফে’ (বহুবচন - আহরুফ) নাযিল হয়েছে। নিম্নোক্ত হাদিসে ৭টি হারফের পরিবর্তে ভিন্ন সংখ্যক হারফও উল্লেখ হয়েছে। সামুরাহ ইবন জুনদুব হতে ধারাবাহিকভাবে হাসান, কাতাদাহ, হাম্মাদ ইবন সালমা ও আফফান (র.) আমার (আবু উবায়দের) নিকট বর্ণনা করেছেনঃ
নবী করিম(ﷺ) বলেছেন- কুরআন মাজিদ ৭টি হারফে নাযিল হয়েছে। আবু উবায়দ বলেন- ৭টি হারফই সঠিক বলে আমি মনে করি। কারণ, এটি বিপুল সংখ্যক রিওয়ায়েতে উল্লেখ হয়েছে। এ কথার তাৎপর্য এটা নয় যে, কুরআন মাজিদের নির্দিষ্ট একটি শব্দকে ৭ প্রকারের উচ্চারণে তিলাওয়াত করা যায়। প্রকৃতপক্ষে কুরআন মাজিদে সর্বসাকুল্যে মোট ৭টি (আরব) গোত্রের ভাষা সন্নিবেশিত রয়েছে। এর কোনো শব্দের উচ্চারণ হয়তো একটি গোত্রের উচ্চারণ হতে গৃহীত হয়েছে। আবার অন্য কোনো শব্দের উচ্চারণ হয়তো অন্য এক গোত্রের উচ্চারণ হতে গৃহীত হয়েছে। আবার অন্য কোনো শব্দের উচ্চারণ হয়তো অন্য এক গোত্রের উচ্চারণ হতে গৃহীত হয়েছে। এভাবে মোট ৭টি গোত্রের উচ্চারণ হতে এর শব্দ সম্ভারের উচ্চারণ গৃহীত হয়েছে। এই সৌভাগ্যে যে সকল গোত্র সৌভাগ্যমণ্ডিত হয়েছে, তাদের সকলের সৌভাগ্য আবার সমান নয়; বরং এই সৌভাগ্যে এক গোত্র আরেক গোত্রকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ এক গোত্র হতে অন্য গোত্র অপেক্ষা অধিক সংখ্যক উচ্চারণ গৃহীত হয়েছে। শীঘ্রই বর্ণিতব্য বিপুল সংখ্যক হাদিসে এটি বিশদরূপে বর্ণিত হচ্ছে।
মুহাদ্দিস আবু উবায়দ আরো বলেন - ইবন আব্বাস(রা.) হতে ধারাবাহিকভাবে আবু সালেহ ও কালবী বর্ণনা করেছেনঃ কুরআন মাজিদ ৭টি ভাষা-রীতিতে নাযিল হয়েছে। এর ৫টি হচ্ছে - হাওয়াযিন (هوازن) গোত্রের অন্তর্গত আল-আজার (العجر) শাখা গোত্রের ভাষারীতি। আবু উবায়দ বলেন- আল আজার শাখা গোত্রের চারটি উপগোত্র বা উপশাখা রয়েছে। সেগুলো হচ্ছেঃ
(১) বনু আসআদ ইবন বকর (بنو اسعد ابن بكر)
(২) খায়ছাম ইবন বকর (خيثم ابن بكر)
(৩) নাসর ইবন মুআবিয়াহ (نصر ابن معاويه)
(৪) ছাকিফ (ثقيف)
এ ছাড়া (৫) তামিম গোত্রের অধস্তন পুরুষ বনু দারম (بنو دارم)
আবু আমা ইবন আ'লা মন্তব্য করেছেন- “আরবদের মধ্যে বিশুদ্ধতম ভাষায় কথা বলে হাওয়াযিন গোত্রের ঊর্ধ্বতন অংশ।” উক্ত অংশই আল-আজার নামে অভিহিত হয়েছে। উমার(রা.)-এর উক্তি এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছিলেন- কুরআন মাজিদের সংকলনে কুরাঈশ এবং ছাকিফ গোত্রের লোক ব্যতিত অন্য কেউ যেন উচ্চারণ বলে না দেয়।
ইমাম ইবন জারীর [তাবারী] (র.) বলেনঃ ৬ষ্ঠ ও ৭ম ভাষারীতি হচ্ছে –
(৬) কুরাঈশের ভাষারীতি এবং
(৭) খুযাআহ গোত্রের ভাষারীতি।
উক্ত রিওয়ায়েত ইবন আব্বাস(রা.) হতে কাতাদাহ(র.) বর্ণনা করেছেন। তবে ইবন আব্বাস(রা.)-এর সাথে কাতাদাহ(র.) এর সাক্ষাৎ লাভ ঘটেনি। [1]
উবায়দুল্লাহ ইবন আরুল্লাহ ইবন উতবাহ হতে ধারাবাহিকভাবে হাসীন ইবন আবদুর রহমান, হাশীম ও ইমাম আবু উবায়দ বর্ণনা করেছেন যে, রাবী উবায়দুল্লাহ্ বলেন- ইবন আব্বাস(রা.)-এর নিকট কুরআন মাজিদের কোনো আয়াতের অর্থ বা ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি এর অর্থ বা ব্যাখ্যা প্রদান করে স্বীয় সমর্থনে আরব কবিদের কবিতা উদ্ধৃত করতেন। সাঈদ অথবা মুজাহিদ হতে ধারাবাহিকভাবে আবু বিশর, হাশীম ও ইমাম আবু উবায়দ বর্ণনা করেছেনঃ ইবন আব্বাস (রা.) কুরআন মাজিদের وَاللَّيْلِ وَمَا وَسَقَ আয়াতের অন্তর্গত وَسَقَ শব্দের অর্থ করেছেন جمع (সে একত্রিত করেছে)। প্রমাণস্বরূপ তিনি নিম্নোক্ত কবিতা চরণটি উদ্ধৃত করেছেনঃ
قد اتسقن لو يجدن سائقا
অর্থাৎ, “চালক পেলে তারা একত্রিত হতো।”
উল্লেখ্য, وسق ও اتسق এই উভয় শব্দ একই ধাতু و-س-ق হতে উদ্ভূত হয়েছে।
ইকরামা হতে ধারাবাহিকভাবে হেসীন, হাশীম ও ইমাম আবু উবায়দ বর্ণনা করেছেন, ইবন আব্বাস(রা.) فاذا هم بالساهرة আয়াতের অন্তর্ভুক্ত الساهرة শব্দের অর্থ করেছেন- الارض, স্থলভাগ। প্রমাণস্বরূপ তিনি কবি উমাইয়া ইবন আবু সলতের নিম্নোক্ত কবিতা চরণটি উদ্ধৃত করেছেনঃ
وعندهم لحم بحر ولحم ساهرة
“তাদের নিকট সমুদ্রের গোশত এবং স্থলভাগের গোশত উভয়ই রয়েছে।”
ইবরাহীম ইবন মুহাজির হতে ধারাবাহিকভাবে সুফিয়ান ইয়াহিয়া ইবন সাঈদ ও ইমাম আবু উবায়দ বর্ণনা করেছেনঃ ইবন আব্বাস(রা.) বলেন- আমি কুরআন মাজিদের فَاطِرِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ এই অংশের অর্থ জানতাম না। একবার দুইজন বেদুঈন একটি কূপকে কেন্দ্র করে ঝগড়া করছিল। তাদের একজন আরেকজনকে বলল- انا فطرتها- انا ابتداتها – “আমিই একে সর্বপ্রথম নির্মাণ করেছি; আমিই এর গোড়াপত্তন করেছি!” (তার শব্দ প্রয়োগে ইবন আব্বাস(রা) উপরোক্ত শব্দের অর্থ জানতে পারলেন।) উক্ত রিওয়ায়েতের সনদও সহীহ।
উপরে বর্ণিত রিওয়ায়েতসমূহের কোনো কোনো রিওয়ায়েত বর্ণনা করবার পর ইমাম আবু জা'ফর ইবন জারীর তাবারী(র.) বলেন- “এটি প্রমাণিত সত্য যে, কুরআন মাজিদ আরবের সকল গোত্রের ভাষায় (Arabic dialects) নাযিল হয়নি; বরং এদের (আরব গোত্রগুলোর উপভাষা) সংখ্যা তো সাতের অধিক। এমনকি এদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করা অসম্ভব। পক্ষান্তরে কুরআন মাজিদ মাত্র ৭টি ভাষারীতিতে নাযিল হয়েছে। এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, যারা সংশ্লিষ্ট হাদিস نزل القران على سبعة احرف [কুরআন ৭টি আহরুফে নাজিল হয়েছে] -এর এরূপ তাৎপর্য বর্ণনা করেন যে, কুরআন মাজিদে ৭ শ্রেণীর বিষয় যথা আদেশ, নিষেধ, উৎসাহিতকরণ, নিরুৎসাহকরণ, কাহিনী, দৃষ্টান্ত ইত্যাদি বা অনুরূপ ৭টি বিষয় বর্ণিত হয়েছে, তাদের ব্যাখ্যা যে সঠিক নয় এবং পূর্বোল্লেখিত ব্যাখ্যাই (৭টি ভাষারীতি বা শব্দের সাতটি উচ্চারণরীতি) যে সঠিক, এর প্রমাণ কী? এই প্রশ্নের উত্তর এই যেঃ পূর্বযুগীয় কোনো ইমাম অথবা কোনো প্রাজ্ঞ ব্যক্তি কি উক্ত হাদিসের উপরিউক্তরূপ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন? যারা বলেন, কুরআন মাজিদ ৭ শ্রেণীর বিষয় যথা আদেশ, নিষেধ ইত্যাদি বর্ণিত হয়েছে, তাঁরা এরূপ দাবি করেননি যে, এটি [نزل القران على سبعة احرف] হাদিসাংশের ব্যাখ্যা। তারা যা বলেছেন, তা সঠিক ও শুদ্ধই বটে। প্রকৃতপক্ষে নবী করীম(ﷺ) এবং একদল সাহাবী হতেই বর্ণিত হয়েছে نزل القران على سبعة ابواب الجنة – “নিশ্চয়ই কুরআন জান্নাতের ৭টি দরজায় নাযিল হয়েছে।” ব্যাখ্যাকারদের উপরিউক্ত ব্যাখ্যা উক্ত হাদিসেরই ব্যাখ্যা (এবং ৭ আহরুফের হাদিসের সাথে এর সম্পর্ক নেই)। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, উক্ত হাদিস [نزل القران على سبعة ابواب الجنة] ইতিপূর্বে উবাই ইব্ন কা'ব(রা.) ও ইবন মাসউদ(রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম ইবন জারীর [তাবারী] (র.) বলেন- “জান্নাতের সাতটি দরজার তাৎপর্য হচ্ছে কুরআন মাজিদে বর্ণিত ৭ শ্রেণীর বিষয় ও আদেশ, নিষেধ, উৎসাহিতকরণ, নিরুৎসাহকরণ, কাহিনী, দৃষ্টান্ত ইত্যাদি। একে এই কারণে ‘জান্নাতের ৭টি দরজা' নামে অভিহিত করা হয়েছে যে, বান্দা সেগুলো যথাযথভাবে পালন করলে তার জন্যে জান্নাতের ৭টি দ্বারই উন্মুক্ত তথা ওয়াজিব ও প্রাপ্য হয়ে যায়।” অতঃপর ইমাম ইবন জারীর দীর্ঘ এক প্রবন্ধ লিখেছেন। এর সারমর্ম এই যে, কুরআন মাজিদ ৭টি কিরাআতে তিলাওয়াত করাকে শরিয়ত এই উম্মতের জন্যে জায়েয রেখেছে।
ইবন জারীর(র.) আরো বলেন- “কুরআন মাজিদ আরবী ভাষার ৭টি উচ্চারণ রীতিতে নাযিল হলেও এবং ৭টি উচ্চারণ রীতিতে এটি তিলাওয়াত করা জায়েয হলেও আমিরুল মু'মিনীন উসমান(রা.) যখন দেখলেন যে, লোকেরা উহা বিভিন্নরূপে তিলাওয়াত করছে এবং এই বিষয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হচ্ছে, তখন তাঁর মনে আশঙ্কা জাগল যে, ভবিষ্যতে মানুষ স্বকপোলকল্পিত উচ্চারণের শব্দ কুরআন মজীদে প্রক্ষিপ্ত করে দেবে এবং এর ফলে প্রকৃত ও বৈধ উচ্চারণসমূহ উদ্ধার করা কঠিন বা অসম্ভব হয়ে পড়বে। কুরআন মাজিদকে হিফাজত করবার জন্যে তিনি এর মাত্র একটি উচ্চারণরীতি (উপভাষা/Dialect) বহাল রাখলেন। অবশিষ্ট ৬টি কিরাআত বা উচ্চারণরীতি পরিত্যক্ত হল। সেই একটি মাত্র উচ্চারণ রীতিতে সারা বিশ্বে কুরআন মাজিদ সংরক্ষিত ও পঠিত হয়ে আসছে। সমগ্র সাহাবীকুল তথা সমগ্র মুসলিম উম্মাহ উসমান(রা.)-এর এই কর্মকে রুশদ ও হিদায়েত বিবেচনা করে এর প্রতি স্বতোৎসারিত আনুগত্য প্রদর্শন করেছেন। ৭টি কিরাআতের [2] মধ্য হতে ৬টিকে পরিত্যাগ করে মাত্র ১টি কিরাআতে সারা বিশ্বে কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত করবার মধ্যে তাঁরা এই উম্মতের জন্যে খায়ের ও বরকত নিহিত মনে করেছেন। আজ আর সে পরিত্যক্ত ৬টি উচ্চারণরীতি বা কিরাআত উদ্ধার করা সম্ভব নয়। [3] কেউ চাইলেও উক্ত ৬টি কিরাআতের কোনটিতে কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত করিতে সমর্থ হবে না।
এখন প্রশ্ন দেখা দেয়, স্বয়ং নবী করীম(ﷺ) যে সকল কিরাআত বা উচ্চারণরীতিতে সাহাবীগণকে কুরআন মাজিদ শিক্ষা দিয়েছেন, তা পরিত্যাগ করা উসমান(রা.) তথা সাহাবীকুলের জন্যে কিভাবে জায়েয হতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর এই যে - শরিয়ত ৭টি কিরাআতের প্রত্যেকটিতে কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত করা ফরয বা ওয়াজিব করেনি। শরিয়ত শুধু ৭টি কিরাআতের যে কোনো কিরাআতে কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত করবার অনুমতি প্রদান করেছে। বস্তুত ৭টি কিরাআত বহাল রাখা ফরয বা ওয়াজিব নয়; বরং কুরআন মাজিদের তিলাওয়াতে ৭টি কিরাআত ভিন্ন অন্য কোনো কিরাআত আমদানী করা অবৈধ। উসমান(রা.) এবং সাহাবীগণ তা (নতুন কোনো কিরাআত আমদানী) করেননি। বরং ফরয বা ওয়াজিব নয় এমন অনুমোদিত ৬টি কিরাআতকে বাদ দিয়েছেন মাত্র। কেন তাঁরা সেগুলো বাদ দিলেন? তাঁরা দেখলেন, ১টি বিশেষ কিরাআত বা উচ্চারণে কুরআন মাজিদ সংকলিত হয়ে যাবার পর সে অনুযায়ী তা তিলাওয়াত করা কোনো (আরব) গোত্রের লোকের পক্ষেই, এমনকি বিশ্বের কোনো লোকের পক্ষেই অসম্ভব বা কষ্টকর হবে না। অধিকন্তু, কুরআন মাজিদের কিরাআত নিয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবার এবং অশুদ্ধ ও অননুমোদিত উচ্চারণরীতি এতে প্রবেশ করিয়ে দেবার পথ এর দ্বারা চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যাবে। মূলত এটিই হয়েছে। কুরআন মাজিদ এবং একমাত্র কুরআন মাজিদই মানব জাতির নিকট বিদ্যমান নির্ভুল ও প্রক্ষেপমুক্ত আসমানী গ্রন্থ। আল্লাহ তা'আলা তাঁর কিতাব সংরক্ষণ করবার বিনিময়ে পবিত্র হৃদয় সাহাবীগণকে আখিরাতে মহা পুরস্কারে পুরস্কৃত করুন।
অতঃপর একটি বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করা প্রয়োজন। কুরআন মাজিদের মাত্র ১টি কিরাআত আমাদের মধ্যে বর্তমান থাকলেও এর শব্দের মূলরূপ অপরিবর্তিত রেখে কোনো কোনো শব্দের কোনো কোনো অক্ষরে (رفع) কর্তৃকারকে বিভক্তি (نصب) কর্মকারকের বিভক্তি এবং (جر) সম্বন্ধ পদের বিভক্তি স্থাপন, (تسكين) হসন্তকরণ, (تحريك) স্বরান্তকরণ, শব্দের অন্তর্গত বর্ণের অবস্থান পরিবর্তন ইত্যাদি ব্যাপারে মতভেদ করা হাদিসে উল্লেখিত নিষেধকে অমান্য করা নয়। সংশ্লিষ্ট হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, “অনুমোদিত ৭টি কিরাআতের বিষয় নিয়ে ঝগড়া করা কুফর।” বস্তুত উপরাল্লেখিত শ্রেণীর মতভেদ [4] করা ৭টি অনুমোদিত কিরাআতের বিষয় নিয়ে মতভেদ করা নয়। উম্মতের কোনো বিজ্ঞ ব্যক্তিই উপরিউক্ত রূপ মতভেদকে ‘কুফর' নামে আখ্যায়িত করেননি।
আলোচ্য পরিচ্ছেদে ইমাম বুখারী(র.) কর্তৃক বর্ণিত দ্বিতীয় হাদিসে আছে যে, উমার(রা.) হতে ধারাবাহিকভাবে মিসওয়ার ইবন মাখরামাহ ও আবদুর রহমান ইবন আবদুল কারী, উরওয়াহ ইবন যুবায়ের, ইবন শিহাব, ওকায়ল, লায়ছ, সাঈদ ইবন উফায়র ও ইমাম বুখারী বর্ণনা করেছেনঃ উমার(রা.) বলেন- একবার আমি নবী করীম(ﷺ)-এর জীবদ্দশায় হিশাম ইবন হাকীমকে সুরা ফুরকান তিলাওয়াত করতে শুনলাম। আমি তাঁর কিরাআতের প্রতি মনোযোগী হয়ে জানতে পারলাম, সে কতগুলো বর্ণ বৃদ্ধি করে তা তিলাওয়াত করছে। নবী করীম(ﷺ) আমাকে.তা সেভাবে তিলাওয়াত করা শেখাননি। আমার অবস্থা এই হল যে, তাঁর নামাযের মধ্যেই তাঁকে পাকড়াও করি আর কী। তাঁর নামায শেষ করা পর্যন্ত আমি ধৈর্যধারণ করে রইলাম। নামায শেষ হবার পর আমি তাঁর চাদর টেনে ধরে জিজ্ঞেস করলাম- আমি তোমাকে যে সুরাটি তিলাওয়াত করতে শুনলাম, তা তোমাকে কে শিক্ষা দিয়েছে? সে বলল- আমাকে তা নবী করীম(ﷺ) শিক্ষা দিয়েছেন। আমি বললাম- তুমি মিথ্যা বলছো! কারণ, তুমি তা যেভাবে তিলাওয়াত করেছ, নবী করীম(ﷺ) আমাকে তা অন্যভাবে শিক্ষা দিয়েছেন। আমি তাঁকে নবী করীম(ﷺ)- এর নিকট টেনে নিয়ে গেলাম। নবী করীম(ﷺ)-এর খিদমতে আরয করলাম- হে আল্লাহর রাসূল! আমি এই লোকটিকে কতগুলো অতিরিক্ত বর্ণসহ সুরা ফুরকান তিলাওয়াত করতে শুনেছি। আপনি উক্ত অতিরিক্ত বর্ণসমূহ সহ আমাকে তা শিক্ষা দেননি। নবী করীম(ﷺ) বললেন- “হে হিশাম! তুমি পড়ে শোনাও তো।” আমি তা ইতিপূর্বে যেভাবে তিলাওয়াত করতে শুনেছিলাম, সে তা সেইভাবে তিলাওয়াত করে নবী করীম(ﷺ)-কে শোনালো। নবী করীম(ﷺ) বললেন- তা এইভাবেই নাযিল হয়েছে। অতঃপর আমাকে বললেন- “হে উমার! তুমি পড়ে শোনাও তো।” নবী করীম(ﷺ) তা আমাকে যেভাবে শিখিয়েছেন, আমি তাঁকে তা সেইভাবে তিলাওয়াত করে শোনালাম। তিনি বলিলেন, “তা এভাবেই নাযিল হয়েছে। কুরআন মাজিদ নিশ্চয়ই ৭টি হারফে (বহুবচন - আহরুফ) নাযিল হয়েছে। এর যে হারফে তোমরা (কুরআন মাজিদ) তিলাওয়াত করতে পারো, সেই হারফে তিলাওয়াত করো।” ইমাম আহমাদ, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম তিরমিযী এবং ইমাম বুখারীও উক্ত হাদিস ইবন শিহাব যুহরীর মাধ্যমে একাধিক সনদ শাখায় বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমাদ তা আবদুর রহমান ইবন আব্দুল কারী হতে ধারাবাহিকভাবে উরওয়াহ, যুহরী ও মালিক ইবন মাহদীর সনদেও প্রায় অনুরূপ অর্থে বর্ণনা করেছেন।
আবু তালহা হতে ধারাবাহিকভাবে আবদুল্লাহ্ ইবন আবু তালহা, ইসহাক ইন আবদুল্লাহ্, হারব ইবন সাবিত, আবদুস সামাদ ও ইমাম আহমাদ (র.) বর্ণনা করেছেন। একবার জনৈক ব্যক্তি উমার(রা.)-এর সামনে কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত করলে উমার(রা.) তাঁর কিরাআতকে ভ্রান্ত ও অশুদ্ধ আখ্যায়িত করলেন। লোকটি বলল- “আমি নবী করীম(ﷺ)-এর সম্মুখে এইভাবেই তিলাওয়াত করেছি। তিনি তো আমার কিরাআতকে অশুদ্ধ বলেননি।” এরপর তাঁরা উভয়ে নবী করীম(ﷺ)-এর নিকট উপস্থিত হলেন। লোকটি নবী করীম(ﷺ)-এর সামনে সেইভাবে তিলাওয়াত করলেন। নবী করীম(ﷺ) তাঁকে বললেন- “তুমি সঠিক ও শুদ্ধরূপেই পড়েছেন।” এতে উমার(রা.) আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। নবী করীম(ﷺ) বললেন- “হে উমার! কুরআন মাজিদের সকল কিরাআতই সহীহ ও শুদ্ধ, যতক্ষণ না তুমি (এতে বর্ণিত) আযাবকে মাগফিরাতে এবং মাগফিরাতকে আযাবে রূপান্তরিত করে দাও।” উক্ত হাদিসের সনদ গ্রহণযোগ্য। এর অন্যতম রাবী হারব ইন সাবিত ‘আবু সাবিত' নামেও পরিচিত। কোনো সমালোচক তাঁকে বিরূপভাবে সমালোচনা করেছেন বলে আমার জানা নেই (অর্থাৎ তিনি একজন নির্ভরযোগ্য রাবী)।
[তাফসির ইবন কাসির, ১ম খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ) পৃষ্ঠা ৬৭-৭২ দ্রষ্টব্য]
আরো পড়ুনঃ
কুরআনের ৭ হারফ এবং ১০ কিরাআত - ইবন তাইমিয়া(র.)
সাত হারফ [‘সাবআতুল আহরুফ’ / ৭টি উপভাষা / 7 Dialects] কি কুরআনের একাধিক ভার্সন?
আল কুরআন সংকলন ও সংরক্ষণের বিস্তারিত ইতিহাস
দেখুনঃ
"কুরআনের বিভিন্ন কিরাত এবং আহরুফ কি কুরআনের ভিন্ন ভিন্ন ভার্সন?_শায়খ আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া"
পাদটিকা
[1] ইমাম ইবন হাজার(র.), খতিব বাগদাদী(র) প্রমুখের মতে, সিকাহ রাবীদের থেকে তাদলিসের ফলে বর্ণনা দুর্বল হয় না। বর্ণনা নির্ভরযোগ্যই থাকে। কাতাদাহ(র.) একজন সিকাহ রাবী।
দেখুনঃ আন নুকাত ‘আলা কিতাব ইবন সালাহ – ইবন হাজার আসকালানী, পৃষ্ঠা ৬১৪
আল কিফায়াহ - খতিব আল বাগদাদী, পৃষ্ঠা ৩৬২
[2] এখানে এই ‘কিরাআত’ বলতে হাফস, ওয়ারশ, ক্বালুন ইত্যাদি পঠন পদ্ধতি বা কিরাআতকে বোঝাচ্ছে না বরং কুরআনের বিভিন্ন আহরুফ বা উপভাষা (Dialect) কে বোঝাচ্ছে যেসব আহরুফে কুরআন নাজিল হয়েছিলো।
[3] অনেক সময়ে বিভিন্ন প্রাচীন মসজিদ থেকে কুরআনের এই সকল ভিন্ন আহরুফ (Dialect) এর কুরআনের খণ্ডাংশ (Fragments) পাওয়া যায় যেগুলোতে অল্প কিছু জায়গায় বর্তমানে বিশ্বব্যপি প্রচলিত কুরআনের চেয়ে ভিন্ন ধরণের শব্দ বা বাক্য দেখা যায়। সেগুলো প্রকৃতপক্ষে সেই সকল ৬ আহরুফে লিখিত কুরআনের খণ্ডাংশ যেগুলো এখন আর মুসলিম উম্মাহ তিলাওয়াত করে না। এগুলো দেখিয়ে অনেক সময়ে খ্রিষ্টান মিশনারী ও নাস্তিক-মুক্তমনারা দাবি করতে চায় এগুলো কুরআনের ভিন্ন ‘ভার্সন’, কুরআন নাকি বিকৃত হয়ে গেছে (নাউযুবিল্লাহ)। তাদের দাবি যে একেবারেই অসার তা আমরা আলোচ্য প্রবন্ধে দেখেছি। স্বয়ং আল্লাহই ভিন্ন ভিন্ন আহরুফে কুরআন নাজিল করেছিলেন। এগুলো মানুষের বানানো আলাদা ভার্সন নয়। উম্মাহর কল্যাণের জন্য সাহাবীদের ইজমা বা ঐক্যমতের ভিত্তিতে ১টি আহরুফে এখন কুরআন তিলাওয়াত করা হয়।
[4] এগুলোই হচ্ছে প্রচলিত হাফস, ওয়ারশ, ক্বালুন ইত্যাদি বিভিন্ন ব্যাকরণগত কিরাআত।
হাফস কিরাতের বর্ণনাক্রমঃ
ওয়ারশ ও ক্বালুন কিরাতের বর্ণনাক্রমঃ
[হাফস, ওয়ারশ ও ক্বালুন কিরাতের বর্ণনাক্রমের ছবির জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ মুহাম্মাদ সাদাত]